ইন্দোচায়নিজ টাইগার (Panthera tigris corbetti): যার খাদ্যতালিকা প্রায় ছয়টি বোলিং বলের সমান

 ইন্দোচায়নিজ টাইগার: রহস্যময় ও বিপন্ন একটি বাঘ প্রজাতির গল্প

ইন্দোচায়নিজ টাইগার, বৈজ্ঞানিক নাম Panthera tigris corbetti, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক অনন্য ও রহস্যময় বাঘ। এটি তার সোনালি বা কমলা রঙের গায়ে কালো ডোরা দাগের জন্য পরিচিত। এই বাঘের প্রতিটি ডোরা দাগ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, অর্থাৎ কোনো দুটি বাঘের ডোরা দাগ এক নয়। এই প্রজাতি বর্তমানে বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। এই ব্লগে আমরা ইন্দোচায়নিজ টাইগারের জীববিজ্ঞান, পরিবেশ, হুমকি, এবং সংরক্ষণ প্রচেষ্টার বিস্তারিত আলোচনা করব।

ইন্দোচায়নিজ টাইগার,স্তন্যপায়ী,বাঘ,Panthera tigris corbetti,সংকটাপন্ন প্রাণী,



ইন্দোচায়নিজ টাইগারের বিবর্তন ও উত্পত্তি

ইন্দোচায়নিজ টাইগারের পূর্বপুরুষ হিসেবে ধরা হয় মায়াসিড নামের একটি প্রাণীকে, যা ৫০ মিলিয়ন বছর আগে বাস করত। বর্তমানে বিদ্যমান বিড়াল প্রজাতির ৪০টি শাখার অন্যতম হলো এই টাইগার। টাইগারের প্রথম ফসিল প্রায় ২০ লাখ বছর আগে দক্ষিণ এশিয়ায় পাওয়া গিয়েছিল।

এই প্রজাতির নামকরণ করা হয়েছে বিখ্যাত শিকারি ও সংরক্ষণবিদ জিম করবেটের নামে। ইন্দোচায়নিজ টাইগার তুলনামূলকভাবে বাঘ প্রজাতির অন্যান্য সদস্যের চেয়ে ছোট, যেমন বেঙ্গল টাইগার বড় কিন্তু মালয়ান টাইগার থেকে বড়।


প্রজাতির বৈচিত্র্য

বর্তমানে ছয়টি প্রধান টাইগার প্রজাতি বিদ্যমান:

  1. বেঙ্গল টাইগার
  2. সুমাত্রান টাইগার
  3. দক্ষিণ চীনা টাইগার
  4. সাইবেরিয়ান টাইগার
  5. মালয়ান টাইগার
  6. ইন্দোচায়নিজ টাইগার

তিনটি প্রজাতি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে:

  • বালি টাইগার
  • জাভান টাইগার
  • কাস্পিয়ান টাইগার


রূপ ও আচরণ

ইন্দোচায়নিজ টাইগারের গায়ে কমলা বা সোনালি রঙ এবং কালো ডোরা দাগ থাকে। বাঘের পেট, মুখ, এবং ঘাড়ের কিছু অংশ সাদা। এই ডোরা দাগ বনের ছায়ার সাথে মিশে থাকার কারণে শিকারিদের চোখে সহজে ধরা পড়ে না।

ইন্দোচায়নিজ টাইগারের শক্তিশালী চোখ রাতের বেলায় শিকারের জন্য খুব কার্যকর। এদের শ্রবণশক্তি খুবই তীক্ষ্ণ, যা শিকার চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। টাইগারদের নখ অত্যন্ত ধারালো এবং প্রয়োজনে নখকে পায়ের ভেতরে লুকিয়ে রাখতে পারে।

পুরুষ বাঘ সাধারণত ৮.৫ থেকে ৯.৫ ফুট লম্বা এবং ৩৩০ থেকে ৪৩০ পাউন্ড ওজনের হয়। অন্যদিকে, স্ত্রী বাঘ ৭.৫ থেকে ৮.৫ ফুট লম্বা এবং ২২০ থেকে ২৯০ পাউন্ড ওজনের হয়।


বিস্তারের অঞ্চল

ইন্ডোচাইনিজ টাইগারদের প্রধান বাসস্থান হিসেবে নির্বাচিত এলাকা হল:

  • ভিয়েতনাম: এখানে সবচেয়ে বেশি এই টাইগার দেখা যায়, বিশেষ করে দুঃসাধ্য বনাঞ্চলে।
  • থাইল্যান্ড: থাইল্যান্ডের বিভিন্ন জাতীয় উদ্যানে এই টাইগারদের বাস রয়েছে, যেমন 'কাঞ্জানাবুরি' এবং 'হুয়াই খা ক্যাং'।
  • কেম্বোডিয়া এবং মিয়ানমার: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দুটি দেশের অনাবৃত বনে এসব টাইগারদের বিস্তার রয়েছে।
  • দক্ষিণ চীন: চীনে এর বিচ্ছিন্ন বাসস্থান রয়েছে, কিন্তু পরিবেশগত পরিবর্তন এবং মানবসৃষ্ট হুমকি কারণে এটি ক্রমশ হুমকির সম্মুখীন।

বাসস্থান ও অভ্যাস

ইন্দোচায়নিজ টাইগারের প্রধান বাসস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, এবং কম্বোডিয়ার বনাঞ্চল। এরা উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুতে বাস করে এবং প্রায়ই বনের গভীরে লুকিয়ে থাকে। খাবারের অভাব হলে এরা পর্বতের উঁচু এলাকায় অভিবাসন করে।


খাদ্যতালিকা

ইন্দোচায়নিজ টাইগার একটি মাংসাশী প্রাণী। এরা সাধারণত সাম্বার হরিণ, বন্য শূকর, গরু এবং বুনো গবাদি পশু শিকার করে। খাদ্যের অভাবে এরা বানর, হগ ব্যাজার এমনকি সজারুও খায়। একটি টাইগার একবারে প্রায় ৮৮ পাউন্ড মাংস খেতে পারে, যা প্রায় ছয়টি বোলিং বলের সমান।


প্রজনন ও সন্তান পালন

ইন্দোচায়নিজ টাইগারের প্রজনন ঋতু নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। স্ত্রী টাইগার গন্ধ নির্গত করে পুরুষ টাইগারকে আকর্ষণ করে। গর্ভধারণকাল প্রায় ১৬ সপ্তাহ এবং প্রতিবার ২ থেকে ৬টি শাবকের জন্ম দেয়। জন্মের সময় শাবক অন্ধ থাকে এবং প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করে।

শাবকেরা ১৮ থেকে ২৪ মাস বয়সে মায়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে নিজস্ব জীবন শুরু করে। ইন্দোচায়নিজ টাইগারের গড় আয়ু ১৫ থেকে ২৬ বছর।


বিপন্নতার কারণ

ইন্দোচায়নিজ টাইগার শিকারি এবং বাসস্থান ধ্বংসের কারণে বিপন্ন। মানুষের হাতে এরা প্রায়ই শিকার হয় তাদের চামড়া, নখ, এবং মাংসের জন্য। বন ধ্বংস এবং রাস্তাঘাট তৈরির ফলে এদের প্রাকৃতিক বাসস্থানও হ্রাস পাচ্ছে।

ইন্দোচায়নিজ টাইগার,স্তন্যপায়ী,বাঘ,Panthera tigris corbetti,সংকটাপন্ন প্রাণী,



সংরক্ষণ প্রচেষ্টা

ইন্দোচায়নিজ টাইগার সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এদের শিকার করলে জেল জরিমানার বিধান রয়েছে। এছাড়াও, চিড়িয়াখানায় এই প্রজাতির ৬০টিরও বেশি বাঘ রাখা হয়েছে সংরক্ষণ ও বংশবৃদ্ধির জন্য।


বর্তমান জনসংখ্যা

বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩৫০টি ইন্দোচায়নিজ টাইগার টিকে আছে বলে ধারণা করা হয়। থাইল্যান্ডে এদের সর্বাধিক সংখ্যা রয়েছে।


উপসংহার

ইন্দোচায়নিজ টাইগার আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের একটি অপরিহার্য অংশ। এদের সংরক্ষণ শুধু একটি প্রজাতি রক্ষা নয়, বরং আমাদের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষারও একটি দায়িত্ব। তাই এদের সুরক্ষায় আমাদের সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে।


Post a Comment

1 Comments

  1. I think, this is an interactive post that never I seen before, especially, in Bengali language about the animals and birds of Bangladesh.

    ReplyDelete